আপনার ব্যবসার জন্য ব্র্যান্ডিং কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ব্র্যান্ডিং কী?

মার্কেটিং বলতে আমরা কমবেশি সবাই বুঝি। আপনার পণ্য, সেবা বা ক্যাম্পেইনের প্রচার করাই হলো মার্কেটিং। কিন্তু ব্র্যান্ডিং নিয়ে অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। আবার অনেকে মনে করেন ব্র্যান্ডিং আর মার্কেটিং একই। আসলে কি তাই? ব্র্যান্ডিং বলতে কি বোঝায়? ব্যবসার জন্য এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ আর আপনার ব্যবসার ব্র্যান্ডিং কীভাবে করবেন? এর সবটাই জানবো আজ।

 

ধরুন আপনি একটি পিৎজার বিজনেস শুরু করলেন। আপনি শহরের সবচেয়ে সেরা পিৎজা তৈরি করেন। কিন্তু সেটি কেউ না জানলে কি আর সেলস হবে? কাস্টমারদের তো অবশ্যই জানতে হবে। শুরুতে মার্কেটে অন্য সেলারদের ভিড়ে আপনার অস্তিত্ব কাস্টমারদের জানান দিতে আপনাকে যেটি করতে হবে তা হলো মার্কেটিং। আপনার পিৎজা যে সেরা সেই গল্প বলবে আপনার আকর্ষণীয় সব সোশ্যাল মিডিয়া কপি, গ্রাফিক ডিজাইন, ফুড ফটোগ্রাফি, লোগো আর স্লোগান। এভাবে একটি কোম্পানির গল্প বলাই হলো ব্র্যান্ডিং। ধরুন দীর্ঘদিনের নিয়মিত ক্রিয়েটিভ মার্কেটিং আর কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স এর মাধ্যমে একদিন আপনার পিৎজা শপ কাস্টমারের মনে এমন সন্তুষ্টির জায়গা করে নিলো যে পিৎজার কথা আসলেই আপনি থাকেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে। তবে বলাই যায় আপনার ছোট্ট পিৎজা শপ আজ একটি ব্র্যান্ড!

 

ব্র্যান্ডিং মূলত মার্কেটে আপনার পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা ও কাস্টমারের মনে স্থায়ী জায়গা করে নেয়া। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ব্র্যান্ডিং একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া। কালার, লোগো, ট্যাগলাইন বা স্লোগান, ব্র্যান্ড ভয়েস, প্রোডাক্ট ইউনিকনেস ইত্যাদি ব্র্যান্ডিং এর বিভিন্ন ম্যাটারিয়াল। যেমন সফট ড্রিংকস এর মধ্যে লাল রঙ মানেই আমাদের মাথায় আসে Coca-Cola ‘র সেই বিখ্যাত টাইপোগ্রাফির লোগো আর নীল মানেই মনে আসে Pepsi ‘র কথা। এটি হলো কালার ব্র্যান্ডিং। আবার ফুটওয়্যার হলেও স্পোর্টস ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে Nike, Adidas আর Puma. এসব ব্র্যান্ড আত্মবিশ্বাস প্রচার করে থাকে। এটি হলো ইমোশনাল ব্র্যান্ডিং। আবার কফির কাপে কাস্টমারের নাম লিখে দেয়া হলো ইউনিক কাস্টমার সার্ভিসের দিক থেকে Starbucks এর ব্র্যান্ডিং স্ট্র্যাটেজি। এভাবেই বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো গ্লোবাল মার্কেটে নিজেদের পরিচয় ও শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। এখানে উল্লেখিত প্রত্যেকটি ব্র্যান্ড এর নাম আমরা শুনেছি, আমাদের মধ্যে প্রায় সবাই এই ব্র্যান্ড গুলোকে চিনি, কারন তারা আমাদের চিনিয়েছে। আর ব্র্যান্ড এর কাজ ই হলো আপনাদের আমাদের মাথার মধ্যে তাদের ব্র্যান্ড নাম বসিয়ে দেয়া। উপরে উল্লেখিত ব্র্যান্ড গুলো তাই করেছে। 

 

ব্র্যান্ডিং কেন গুরুত্বপূর্ণ?

শুধু বড় ব্র্যান্ড নয়, আপনার ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসার জন্যেও ব্র্যান্ডিং এর গুরুত্ব অনেক। ব্র্যান্ডিং এর মাধ্যমে কাস্টমারদের আস্থা অর্জন করা যায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে কাস্টমারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। আর তাই তা বৃদ্ধি করে আপনার ব্যবসার সেলস।

 

ব্র্যান্ডিং এর মূল উদ্দেশ্যই হলো কাস্টমারের মনে জায়গা করে নিয়ে প্রতিযোগিতার ভিড়েও এগিয়ে থাকা। ব্র্যান্ডিং এর মাধ্যমে নিজের প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কাস্টমারদের কাছে অতি সহজেই গ্রহনযোগ্য করে তোলা যায়। এর মাধ্যমে মার্কেটে স্থায়ীভাবে পরিচিত হয় আপনার ব্র্যান্ড। অন্য দশজনের আস্থা দেখে নতুন ক্রেতারা আপনার ব্র্যান্ডে আকৃষ্ট হয়। তাছাড়া সরাসরি টার্গেট অডিয়েন্সের সাথে সংযোগ স্থাপন করা যায়। ব্র্যান্ড সবসময় মানুষের আলোচনায় থাকে, ফলে ওয়ার্ড-অব-মাউথ মার্কেটিং হয় সহজেই। আর এই ওয়ার্ড-অব-মাউথ মার্কেটিং আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস এর সেল দীগুণ বাড়িয়ে দেয়। মানুষ যখন একটি ব্র্যান্ড সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখে তখন তারা সেই ব্র্যান্ড কেই বেশি প্রাধান্য দেয়। এবং যখন তারা কেনাকাটা করতে চায় তখনও ঐ ব্র্যান্ড থেকেই কেনার চেষ্টা করে। আমরা নিজেদের কথাই ভেবে দেখতে পারি, আমরা যখন কোনো কিছু কিনতে চাই আমরা তখন কি করি? আমাদের পরিচিত কোনো যায়গা থেকে কেনার চেষ্টা করি। কারন আমরা ঐ ব্র্যান্ড কে ভালোভাবে চিনি, আমাদের মাথার মধ্যে তারাই আগে চলে আসে। আর একটা ব্র্যান্ড এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানুষের মাঝে যায়গা করে নেয়া। 

আপনার ব্যবসার ব্র্যান্ডিং কীভাবে করবেন? 

এখন প্রশ্ন হলো কীভাবে আপনার ব্যবসার ব্র্যান্ডিং করবেন?

 

১) আপনার টার্গেট কাস্টমার জানুন: সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রায় ৭০ শতাংশ ক্রেতারাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পছন্দ করেন। অর্থাৎ ঠিক তার নিজের চাহিদা, পছন্দ, অপছন্দ, চিন্তাধারার সাথে মিলে এমন ব্র্যান্ড থেকে তারা ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আপনার ব্র্যান্ড ভয়েস ঠিক কাদের উদ্দেশ্য করে হবে তা নির্ধারন করুন। এর জন্য আপনার আইডিয়াল কাস্টমারের জিওগ্রাফিক, ডেমোগ্রাফিক, সাইকোগ্রাফিক ডিটেইলস বুঝে বাইয়ার পারসোনা নির্ধারণ করুন।  যেমন ধরুন আপনি যদি প্রোডাক্ট রিলেটেড বিজনেস করেন এবং তার ব্রান্ডিং করেন সেক্ষেত্রে আপনাকে বুজতে হবে আপনার ঐ প্রোডাক্ট এর বায়ার পারসনা কেমন হবে। বায়ার পারসোনা বুঝে আপনি যদি ব্র্যান্ডিং করতে পারেন তাহলে আপনার ক্রেতারা আপনার ব্র্যান্ড এর সাথে সবসময় কানেক্টেড থাকবে, আপনার করা বিভিন্ন কন্টেন্টে এনগেজড হবে। আপনার ব্র্যান্ড ভ্যালু আরো বৃদ্ধি পাবে। এবং সঠিক কাস্টমার বেইজে পৌঁছাতে পারবে আপনার ব্র্যান্ডের বার্তা। 

 

২) ইনভেস্ট করুন ভিজুয়াল অ্যাসেটে: বিজনেসের যাত্রা শুরু হয় একটি লোগো আর স্লোগান দিয়ে। পরবর্তীতে নানা কন্টেন্টের জন্য প্রয়োজন হয় গ্রাফিক ডিজাইনের। এগুলো বিজনেসের ভিজ্যুয়াল অ্যাসেট। এগুলোতে ইনভেস্ট করা উচিত কেননা এগুলো আপনার Brand Identity বহন করে। একটি ব্র্যান্ড এর সর্বপ্রথম যে বিষয় টি চোখে পরে তা হলো ঐ ব্র্যান্ড এর লোগো, এবং এই লোগো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে সাথে Brand Identity আরো Strong করে। যেমন আমরা যদি Apple, Google, Coca-Cola, Facebook বা Meta এর কথা চিন্তা করি তাহলেই বুঝা যাবে যে একটি লোগো একটি ব্র্যান্ড এর জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন Coca-Cola এর কথা শুনলেই লাল এবং সাদা রং এর Coca-Cola লেখা লোগোর কথা মনে পরে। তার মানে একটি লোগোর সাথে কালারের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। আর আমরা অনেকেই জানি প্রত্যেকটি কালার আলাদা আলাদা অর্থ বহন করে। তাই ব্র্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে আপনার লোগো এবং আপনার ব্র্যান্ড এর বার্তা বহন করবে এমন কালার পছন্দ করা অতি গুরুত্বপূর্ণ।

 

৩) ব্র্যান্ডের লক্ষ্য স্থির করুন: আপনার ব্যবসা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা চাই। আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে আপনি কাস্টমারকে ঠিক কি ভ্যালু দিতে চান, আগামী দুই বা পাঁচ বছরে আপনার কোম্পানিকে কোথায় নিয়ে যেতে চান। আপনার ব্র্যান্ড কাস্টমারকে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারবে, আপনি ব্র্যান্ডিং এর মাধ্যমে কি পেতে চান, আপনি ব্র্যান্ডিং কেনো করবেন। প্রত্যেটি বিষয় জেনে সঠিক লক্ষ্য এবং স্ট্রাটজি ফলো করে আপনাকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। এবং এই বিষয়ে নিশ্চিত থাকলে তবেই আপনার ব্র্যান্ড ভয়েস হবে স্পষ্ট। 

 

৪) থাকুন অন্যদের থেকে আলাদা: ইউনিক সেলিং প্রোপোজিশন বা সংক্ষেপে ইউএসপি হলো আপনার ব্র্যান্ড অন্য সবার থেকে যেদিক দিয়ে আলাদা। আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিসে ইউনিক কোনো ফিচার যোগ করুন। মার্কেটিং কৌশলেও ভিন্নধর্মী, সৃজনশীল কোনো আইডিয়া নিয়ে কাজ করুন যাতে কাস্টমারদের নজর কাড়ে। মার্কেট এনালাইসিস করতে হবে এবং কম্পিটিটর রিসার্চ করে গ্যাপ খুঁজে বের করতে হবে। পরবর্তীতে সেই গ্যাপ ফিল আপ করতে পারলে কাস্টমার অতি সহজেই আপনার ব্র্যান্ডকে গ্রহন করে নিবে। তাই মার্কেট এনালাইসিস করে USP বের করতে হবে এবং তার প্রোপারলি মার্কেটিং করতে হবে।

 

৫) কাস্টমার সার্ভিসে প্রাধান্য দিন: ব্র্যান্ডিং এর মূল উদ্দেশ্য যেহেতু কাস্টমারের মনে জায়গা করে নেয়া তাই ক্রেতাদের সন্তুষ্টি অর্জনে সবসময় প্রাধান্য দেয়া উচিত। প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের গুনগত মান নিশ্চিত করতে হবে। সেইসাথে প্রফেশনাল আচরণ, কমিউনিকেশন এসবের মাধ্যমে কাস্টমার সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। আমরা অনেকেই জানি একটি ব্র্যান্ড টিকিয়ে রাখতে কাস্টমারদের ভুমিকা সবচেয়ে বেশি। আপনার কাস্টমাররা যদি আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিসে সন্তুষ্ট থাকে তাহলে তারা আবার রিটেইন করবে, তারা আরো মানুষকে আপনার ব্র্যান্ড সাজেস্ট করবে, আপনার ব্র্যান্ড নিয়ে Advocacy করবে, এতে আপনার ব্র্যান্ড এর লক্ষ্যে আপনি অতি দ্রুত পৌছাতে পারবেন। তাই আগে হোক ব্র্যান্ডিং তারপর হোক সেলিং।

 

আপনার ব্যবসার ব্র্যান্ডিং শুরু হোক আজই। 

 

Posted in Blog

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*