কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট কী ও কীভাবে করবেন?

ব্যবসায় সিআরএম একটি পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত টার্ম। এর পূর্ণরূপ হলো কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট। অর্থাৎ আপনার সমস্ত কাস্টমারদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে তাদের একটি সন্তোষজনক কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স দেয়া। কাস্টমারদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার দ্বারাই একটি বিজনেসের স্কেলআপ হয়ে থাকে।

 

বিশ্বের সবচেয়ে ভালো কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট হল অ্যাপলের। তারা তাদের কাস্টমারদের অ্যাপল আইডি ব্যবহার করে তাদের বিহেভিয়ার জানার চেষ্টা করে এবং সে অনুযায়ী তাদের পরবর্তী ফোন গুলো রিলিজ করে থাকে। এছাড়াও তাদের কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট থেকে তাদের টার্গেট মার্কেট নির্ণয় করতেও অনেক এডভান্টেজ পেয়ে থাকে।

 

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসাধারণ কাস্টমার ম্যানেজমেন্টের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ কোকা-কোলা কোম্পানি। তারা কৌশলের সাথে সিআরএম ব্যবহার করে কাস্টমারদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে, তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে এবং বিশেষ অফারগুলো প্রচার করে।

 

আমাদের দেশের কাস্টমার ম্যানেজমেন্টের সব থেকে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল গ্রামীনফোন। তারা তাদের সিআরএম কাস্টমারদের নিড, ডিমান্ড এর ব্যাপারে রিপোর্ট করে সে অনুযায়ী তাদের প্যাকেজগুলো রেডি করে থাকে।

 

কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট বলতে বেশীরভাগ সময়ে যে টার্ম ইউজ হয় তা হল সি আর এম। এই সি আর এম এর মাধ্যমে আপনি আপনার কাস্টমারদের বিস্তারিত ইনফরমেশন কালেক্ট করে রাখতে পারবেন এবং সেই অনুযায়ী আপনি আপনার কাস্টমারদেরকে টার্গেট করতে পারবেন এবং নতুন নতুন ক্যাম্পেইন একটিভ করতে পারবেন। এই কাস্টমারদের বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণকেই কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট বলা হয়ে থাকে।

 

কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বলা বাহুল্য, ব্যবসার প্রাণ হলো কাস্টমার। আর তাদের সন্তুষ্টি অর্জন হলো ব্যবসায় সাফল্যের মূলমন্ত্র। তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে না পারলে এই সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব নয়। কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স একটি স্পর্শকাতর বিষয়। একটি খারাপ অভিজ্ঞতার জন্য আপনি হারাতে পারেন আপনার দীর্ঘদিনের লয়্যাল কাস্টমার।

 

কথায় আছে “টাকায় টাকা আনে”। ঠিক তেমনি একজন কাস্টমার আরও অনেক কাস্টমার আনতে পারেন। কারন যেকোন কিছুর চেয়ে কাস্টমারদের রিভিউ সবচেয়ে বেশী কার্যকর হিসেবে কাজ করে থাকে। কারন Word of Mouth মার্কেটিং হচ্ছে সবচেয়ে স্ট্রং মার্কেটিং। এর দ্বারা সবচেয়ে বেশী ক্লায়েন্ট অনবোর্ড হয়ে থাকে। কাস্টমারদের পজিটিভ রিভিউ থেকে সবচেয়ে বেশী ট্রাস্ট ভেলু তৈরি হয় এবং কাস্টমারবেজ সবচেয়ে বেশী স্ট্রং হয়।

 

কাস্টমারদের বিহেভিয়ার জানার জন্য কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাস্টমারদের বিহেভিয়ার জানা থাকলে আপনি কাস্টমারদের নিড, ডিমান্ড, চাহিদা, ট্রেন্ড, কাস্টমারদের কি পছন্দ তা জানতে পারবেন। এতে করে আপনার কাস্টমারদের বায়িং বিহেভিয়ার জানা সহজ হয় এবং বিজনেসে স্কেলআপ করা আরও সহজ হয়। 

 

মার্কেটিং স্ট্রাটেজি এবং ফোরকাস্টিং এর জন্য কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট অত্যান্ত জরুরী। কারন মার্কেট প্রতিনিয়ন চেঞ্জ হচ্ছে। আর এই চেঞ্জ এর মধ্যে কোন জিনিসটি ভালো কাজ করবে তা জানতে হলে চালাতে হবে এক্সপেরিমেন্ট। আর আমাদের দেশের যারা ছোট পরিসরে ব্যবসা করছে তারা এক্সপেরিমেন্ট করতে সাহস পান না সহজে। তারা ভাবেন যে এক্সপেরিমেন্টের কারনে তাদের যদি বিজনেসের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট ঠিক থাকলে এইসব নিয়ে খুব বেশী বেগ পেতে হয় না।

 

কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস

কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট কৌশল ব্যবহার করে আপনার ব্যবসাকে পরবর্তী ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এই টিপসগুলো অনুসরণ করুন।

 

১) কাস্টমারকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য হতে হবে কাস্টমার কেন্দ্রিক। আপনার নতুন ফিচার আপডেট সম্পর্কে কাস্টমার ফিডব্যাক জানুন। তা কেমন কিংবা তাতে আরও কি যোগ করা যায়, কাস্টমাররা কি চান এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করুন ইমেইল, চ্যাট বা কলে জরিপের মাধ্যমে। এতে করে তারা বিশ্বাস করেন যে আপনার ব্যবসায় তাদের মতামতের মূল্যায়ন করা হচ্ছে, ফলে তারা আপনার ব্র্যান্ডে আস্থা রাখে।

 

২) কাস্টমার ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে আপনার ব্যবসার ব্যয় কমানো সম্ভব। নতুন কাস্টমার আকৃষ্ট করা সহজ নয় আর এতে প্রচুর মার্কেটিং বাজেটও রাখতে হয়। সেটি শিথিল করে বিনিয়োগ করুন বর্তমান কাস্টমারদের সাথে আরও সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনে। এতে করে তাদের আস্থা দেখেই আরও অনেক নতুন কাস্টমার ভিড় করবে আপনার দরজায়।

 

৩) যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবসময় স্বচ্ছতা অবলম্বন করুন। কঠিন কোনো সংবাদ দিতে কিংবা কাস্টমারদের কোনো চাহিদায় ‘না’ বলতে সংকোচ বোধ করা যাবে না। সবসময় কাস্টমারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে সুন্দরভাবে তাকে বুঝিয়ে বিকল্প কিছু অফার করুন যা আপনি তাকে প্রকৃতপক্ষে দিতে পারবেন। কখনো জোরপূর্বক মিথ্যে আশ্বাস দেয়া চলবে না। এর কারণে কাস্টমারদের বিশ্বাসে ফাটল ধরে।

 

৪) আপনার লয়্যাল কাস্টমারদের পুরষ্কৃত করুন। এর একটি বড় উদাহরণ হতে পারে অনলাইন বুকশপ রকমারি। তারা প্রতি বছর তাদের সাইট থেকে সবচেয়ে বেশি বই কেনা ক্রেতাদের একটি লিডারবোর্ড তৈরি করে শীর্ষদের পুরষ্কৃত করে। এতে করে গ্রাহকরা আপনার কাস্টমার হয়ে থাকতে ও আপনার থেকে আরও বেশি কিনতে উৎসাহিত হয়। তাছাড়া মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানি বিকাশ বা নগদের বিভিন্ন ক্যাশব্যাক অফারও এর একটি ভালো উদাহরণ।

 

৫) ব্যবসায়ীরা সবসময় নতুন কাস্টমার পাওয়ার দিকে অধিক মনোযোগী থাকেন ফলে বর্তমান কাস্টমারদের সন্তুষ্ট রাখার দিকে নজর দেয়া হয় না। কিন্তু কাস্টমার কনভারশনের পাশাপাশি কাস্টমার রিটেনশনেই সমান গুরুত্ব দিন। মনে রাখবেন একজন কাস্টমারের জার্নি বিক্রি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বরং একবার বিক্রির পরেও তাকে দেয়ার আছে অনেক কিছু। তাকে বার বার রিটেইন করাতে হবে, এবং তাকে বেস্ট একটি এক্সপেরিয়েন্স দিতে হবে যাতে তার মাধ্যমে আপনার বিজনেসের Advocacy করতে পারেন, যার ফলে আপনি ঐ একই কাস্টমারের মাধ্যমে আরো অনেক কাস্টমারদের কাছে আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস সেল করতে পারবেন। এতে আপনার মার্কেটিং কস্ট কমে আসবে। আর একটি বিজনেসে সফল হওয়ার জন্য রিটেইন কাস্টমার এবং তাদের Advocacy অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই নতুন নতুন কাস্টমার অনবোর্ড করার চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয় কাজ হলো আপনার এক্সিস্টিং কাস্টমারদের গুরুত্ব দেয়া।

 

৬) আপনার ব্যবসার কর্মীদের প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধির দিকে নজর দিন। কর্মীরা উৎফুল্ল থাকলে কাস্টমার সার্ভিস আপনাতেই নিশ্চিত করা সম্ভব। কারন আপনার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে যারা কাস্টমার ম্যানেজমেন্টে কাজ করছেন তারাই মেইনলি কাস্টমারের সাথে কমিউনিকেশন রক্ষার কাজটি করে থাকেন। তাদের যদি মন প্রফুল্ল থাকে তাহলে তারা কাস্টমারদের সাথেও ভালো কমিউনিকেশন রাখতে পারেন যা আপনার বিজনেসের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

৭) কাস্টমারদের সাথে ভালো রিলেশন মেইন্টেইন করতে এবং আপনার কাস্টমাররা আপনার বিজনেস নিয়ে সন্তস্ট আছে কিনা তা জানতে কাস্টমারদের কাছ থেকে রেগুলার ফিডব্যাক কালেক্ট করুন। আপনার পুরোনো কাস্টমাররা আপনার বিজনেস নিয়ে হ্যাপি কিনা তা জানতে তাদের সাথে যোগাযোগ করুন এবং তাদের কাছ থেকেও ফিডব্যাক কালেক্ট করুন। নতুন কাস্টমারদেরকে অনবোর্ড করার ক্ষেত্রে পুরোনো কাস্টমারদের ফিডব্যাক ম্যাজিকের মত কাজ করে থাকে। 

 

৮) আপনার কাস্টমারদেরকে ফিল করাতে হবে যে তারা ইম্পরট্যান্ট। আপনি অবশ্যই আপনার বড় ক্লায়েন্টদের বেশী গুরুত্ব দেবেন এবং ছোট ক্লায়েন্টদের জন্য কম সময় বরাদ্দ রাখবেন। তবে এই বিষয়টি জেন আপনার কাস্টমাররা টের না পান। তাদেরকে বোঝাতে হবে যে তারা আপনার সব থেকে সেরা সার্ভিসটি পাচ্ছেন এবং তারাই আপনার পেজের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।

      

 

বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে কাস্টমার ম্যানেজমেন্ট কাজটি অতি সহজেই করা যায়। এসব সফটওয়্যার বিপুল পরিমাণ তথ্যের উপর ডাটা এনালাইসিস করে কাজ করে। এদের বলে সিআরএম সফটওয়্যার। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য উল্লেখ্যযোগ্য সফটওয়্যার হলো Zoho, Salesforce, Hubspot, Pipedrive, Insightly, Freshsales, Apptivo ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে আপনি অতি সহজেই আপনার কাস্টমারদের ডাটা ম্যানেজ করতে পারবেন এবং তাদের প্রিমিয়াম সাপোর্ট নিশ্চিত করতে পারবেন। সুতরাং আপনার ব্যবসায় সাফল্য ধরে রাখতে ও ব্র্যান্ডিং এর জন্যে কাস্টমার ম্যানেজমেন্টের বিকল্প নেই। 

 

Posted in Blog

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*
*