আপনার যদি একটি বিজনেস থাকে তবে অনেকেরই আপনার প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে যেন আপনি কোটিপতি। কিন্তু যখন কেবল আপনিই জানেন বিজনেসটির পরিসর বড় করতে আপনি কেমন হিমশিম খাচ্ছেন তখন এমন পরিস্থিতি বেশ বিব্রতকরই বটে। আদতে একটি বিজনেস শুরু করার পর প্রতি ধাপেই নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। আপনার ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসার জন্য সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ তা হলো বিজনেসটি স্কেল-আপ করা।
সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে সম্ভাবনার পথ হারিয়ে ফেলতে পারে আপনার ব্যবসা। আবার অসময়ে বড় বড় পদক্ষেপ নিলেও বিজনেসের উপর পড়তে পারে বাড়তি চাপ। গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ৭৪ শতাংশ স্টার্টআপ বিজনেসের ব্যর্থতার পেছনে দায়ী এমন অসময়ে নেয়া বড় সিদ্ধান্ত যাকে বিজনেসের ভাষায় বলে ‘প্রিম্যাচ্যুর স্কেলিং’। তাহলে বোঝা গেলো বিজনেস স্কেল আপ করার প্রক্রিয়াটি বেশ সেন্সিটিভ। অনেক বিষয় বুজে প্ল্যান করে বিজনেস স্কেল-আপের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যে ৬টি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি
এখন প্রশ্ন হলো— তাহলে কীভাবে স্কেল-আপ করবেন আপনার বিজনেস? সহজ ভাষায় স্কেল-আপ করা মানে ব্যবসাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়া, এর পরিসর আরও বড় করা, আরো বেশি গ্রাহকদের মাঝে নিজের বিজনেসকে পৌঁছে দেয়া, বিজনেসের প্রোফিট মার্জিন বাড়ানো। স্কেল-আপ করতে সকল বিজনেসের জন্য কিন্তু একই কৌশল অবলম্বন করলে চলে না। আপনার বন্ধুর ব্যবসায় যে কৌশল কাজ করেছে আপনার ব্যবসায় তা কাজ নাও করতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজনের বিজনেস মডেল অন্যজনের বিজনেস স্কেল-আপে তেমন বেশি কাজে আসে না। তাই আপনার কৌশল কি হবে তা নিরূপণের জন্য কিছু সাধারণ বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখা জরুরি। যেমনঃ
১) আপনার ব্যবসার বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করুন। সামনে আগানোর জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ বুঝতে হলে আগে নিজের বর্তমান অবস্থান বুঝতে হয়। কারন বর্তমান অবস্থা বুঝেই ভবিষ্যৎ প্ল্যান করতে হবে। একইভাবে আপনার বিজনেসের সাম্প্রতিক সকল এনালিটিক্স নিয়ে পর্যালোচনা করুন। যেমন
সেলস কনভারশন রেটঃ আপনি যে পরিমাণ ইনভেস্ট করেছেন এবং তার বিপরীতে আপনার যে পরিমাণ কনভারশন দরকার তা পাচ্ছেন কিনা সে দিকে নজর দিন। একটি বিজনেস টিকে থাকা এবং তা স্কেল-আপ করার জন্য কনভারশন রেট ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরী।
প্রফিট মার্জিনঃ আপনার বিজনেস থেকে যথেষ্ট পরিমাণ প্রফিট মার্জিন আসছে কিনা সে দিকে খেয়াল করুন। কারন বিজনেস স্কেল-আপ তখনি করা উচিত যখন ঐ বিজনেস থেকে ভালো একটা প্রোফিট মার্জিন পাওয়া যায়। আপনার যদি প্রোফিট মার্জিন ভাল না থাকে তাহলে তো বিজনেস স্কেল-আপ করতে হিমশিম খেতে হবে।
কাস্টমার রিটেনশন রেটঃ বিজনেস স্কেল-আপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো কাস্টমার রিটেনশন রেট। আপনা বিজনেসে যদি কাস্টমার রিটেনশন রেট ভালো থাকে, মানে হলো আপনার কাস্টমাররা যদি রিপিটেড হয়ে থাকে তাহলে আপনার বিজনেস স্কেল-আপ তুলনা মূলক সহজ হবে। আর একটি বিজনেস স্কেল-আপ থেকে শুরু করে বিজনেস টিকে থাকতে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি ভুমিকা রাখে তা হলো কাস্টমার রিটেনশন। তাই বর্তমান কাস্টমার রিটেনশন রেট এনালাইসিস করতে হবে।
মার্কেট ট্রেন্ডঃ,
বিজনেস স্কেল-আপ করার জন্য মার্কেট ট্রেন্ড বুজতে হবে। মার্কেট ট্রেন্ড এর সাথে আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস এর বিভিন্ন পরিবর্তন পরিমার্জন করতে হবে।
কাস্টমার ডিমান্ডঃ আপনার কাস্টমারদের ডিমান্ড জানুন, তাদের ডিমান্ড সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রেখেই আপনার বিজনেসের স্কেল-আপ করতে হবে। কারন আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কিন্ত আপনার কাস্টমাররা পারচেজ করবেন। তাই তাদের কথা মাথায় রেখে, তাদের Pain Point এবং Gain Point সবকিছুর দিকে নজর রেখে আপনাকে আপনার বিজনেস স্কেল-আপ করতে হবে।
এই এনালাইটিক্স গুলোর পাশাপাশি আরো অনেক এনালাইটিক্স বুঝে আপনাকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। যত বেশি এনালাইটিক্স নিয়ে পর্যালোচনা করবেন আপনার সিদ্ধান্ত নিতে তত বেশি সহজ হবে। এবং আপনার বিজনেসের স্কেল-আপ দ্রুত করতে পারবেন।
২) নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। লক্ষ্য হওয়া চাই সুনির্দিষ্ট। আপনি আপনার বিজনেসটি স্কেল-আপ করতে চাইলে আপনার লক্ষ্যমাত্রা আসলে কী সেই বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। সকলের সাফল্যের মাপকাঠি বা লক্ষ্যমাত্রা এক নাও হতে পারে। নিজের লক্ষ্য নিয়ে নিশ্চিত থাকলে সেখানে পৌঁছানোর পথ সুগম হয়। যেমন ধরুন আপনি এখন যে অবস্থানে আছেন সেখান থেকে আগামী ৫ বছর পর নিজের বিজনেস কে কোথায় দেখতে চান তার জন্য একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। সেই লক্ষ্য অনুযায়ী প্ল্যান করুন এবং সে অনুযায়ী নিজের বিজনেসের স্কেল-আপ করুন।
৩) আপনার নির্ধারণ করা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে কি পরিমাণ জনবল প্রয়োজন তার একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন। এবার প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ লোক নিয়োগ দিন। মনে রাখবেন, অপরিকল্পিত লোক নিয়োগের কারণে আপনার বিজনেস প্রিম্যাচ্যুর স্কেলিং এর চাপে পড়তে পারে। যেমন আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে ১০ জন দক্ষ লোক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন, কিন্তু আপনি লোক নিয়োগ দিলেন ৫ জন তাহলে কিন্তু আপনি আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন না। আবার ধরুন লোক লাগবে ১০ জন কিন্তু নিয়োগ দিলেন ১৫ জন তখনও কিন্তু আপনার বিজনেস স্কেল-আপ করা কঠিন হয়ে যাবে, কারন এখানে আপনাকে অনেক বেশি খরচ করতে হবে। তাই আপনাকে আগে বুজতে হবে আপনার বিজনেস স্কেল-আপ করার জন্য কি পরিমাণ জনবল প্রয়োজন হবে এবং সেই পরিমাণ দক্ষ লোক আপনি নিয়োগ দিতে পারবেন কিনা।
৪) সবসময় গ্রাহকের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়া জরুরি। কারণ কাস্টমার স্যাটিসফ্যাকশনই আপনার ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি। কাস্টমার কেয়ার আরও উন্নত করতে পারলে আপনার বিজনেস স্কেল-আপ করা সম্ভব। তাই এই বিভাগে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন কিনা সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিন। সমীক্ষায় দেখা যায়, শুধুমাত্র সন্তোষজনক কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্সের জন্য ৮৫ শতাংশ ক্রেতা বেশি ব্যয় করতে সম্মতি প্রকাশ করে। তাছাড়া কাস্টমার যদি আপনার থেকে ভালো অভিজ্ঞতা পায় তাহলে সে আরো কাস্টমার রেফার করবে এবং আপনি প্রতিনিয়ত নতুন কাস্টমার পাবেন এর মাধ্যমে আপনার বিজনেসের স্কেল-আপ অনেক দ্রুত হবে।
৫) আরও বেশি সংখ্যক গ্রাহকের কাছে আকর্ষণীয় করতে আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিসটি কাস্টমাইজ করুন। প্রাইসিং পলিসি পুনর্বিবেচনা করে সম্ভব হলে খরচ কমিয়ে আনুন। ফলে আপনি আকর্ষণীয় প্রাইসে আপনার পণ্য বা সেবাটি আরও বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে অফার করতে পারবেন। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে অফার করতে পারার কারনে দেখা যাবে আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস এর সেলের পরিমাণ বাড়বে। এভাবে আপনার বিজনেসটি স্কেল-আপ করা সম্ভব।
৬) স্কেল-আপ মানেই বিজনেস ডেভলপমেন্ট। আর বিজনেস ডেভলপমেন্ট -এর অন্যতম মাধ্যম হলো স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাথে বিভিন্ন ইভেন্ট বা ক্যাম্পেইনে কোলাবোরেশন করার পরিকল্পনা করুন। পার্টনারশিপের মাধ্যমে আপনার বিজনেস নতুন মার্কেট, কাস্টমার বেইজে পৌঁছে যেতে পারে খুব সহজেই। তাছাড়া নিশ্চিত করতে পারে বেটার কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স। দেশের ই-কমার্স জায়েন্ট দারাজ প্রায়ই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাথে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশীপ করে থাকে। অটোমোবাইল কোম্পানি রিনট এবং নিসান স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গাড়ি বিক্রি ১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
শেষ কথা
সত্যি বলতে, আপনার ব্যবসাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার মন্ত্র হলো গ্রাহকের চাহিদা বোঝা। বিজনেস গ্রোথ বা স্কেল-আপ সম্পূর্ণ নির্ভর করে কাস্টমারের উপর, আপনার বিজনেসে যত বেশি কাস্টমার থাকবে আপনার বিজনেসে তত বেশ প্রোফিট মার্জিন থাকবে, কনভারশন রেট বাড়বে। আর আপনি যখন কাস্টমারের চাহিদা বুজতে পারবেন, একমাত্র তখনই আপনি বিজনেসে কি ধরণের কৌশলগত পরিবর্তন প্রয়োজন তা নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। উপরে আলোচিত ৬ টি বিষয় মাথায় রেখে আপনি আপনার ব্যবসাকে নিয়ে যেতে পারেন অনন্য উচ্চতায়। আর মার্কেটে হয়ে উঠতে পারেন এক শক্ত প্রতিযোগী।
Ezaz Risan
Thanks for the info @ProAdman